ভারতের মুম্বাইভিত্তিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তথা বলিউডের ছবির প্রতি বাংলাদেশি সিনেপ্রেমীরা বেশ দুর্বল। বিশেষ করে ওখানকার বেশিরভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রী, ছবির বাজেট সর্বোপরি নির্মাণশৈলী বাংলাদেশের ছবির চেয়ে অনেক উঁচুতে। গল্পের ক্ষেত্রে হয়তো বিতর্ক আছে, কিন্তু বলিউডের বেশিরভাগ ছবির আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা অযৌক্তিক।
তবে বলিউডও ভারতের আরও কিছু ইন্ডাস্ট্রির কাছ থেকে ধার করা ছবি নিয়ে হাল আমলে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেটা বলাবাহুল্য। তা হল দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। গত কয়েক বছর ধরে ভারতের এ অঞ্চলের ছবির প্রতি বাংলাদেশি দর্শকদেরও আকর্ষণ বেড়েছে। কী আছে সেখানকার ছবিতে? বিস্তারিত লিখেছেন –
বলিউড অভিনেতা সালমান খানের ‘ওয়ান্টেড’ ছবিটি নিশ্চয়ই অনেকে দেখেছেন। পুরনো একঘেয়ে সালমানকে একেবারেই বদলে দিয়েছে এ ছবি। অ্যাকশননির্ভর এ ছবিতে সালমান অভিনয় করেছেন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের আন্ডারকভার এজেন্টের ভূমিকায়। পুরো ছবিতে সালমানের মারদাঙ্গা অভিনয় দর্শকও উপভোগ করেছেন বেশ।
এরপর পুলিশের চরিত্রে ‘দাবাং’ নিয়ে সালমান নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এখনও অনেকে তাকে ‘দাবাংখ্যাত হিরো’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। অথচ যে দুটি ছবি সালমানকে আমূল বদলে দিয়েছে সে ছবি দুটি বলিউডের মৌলিক কোনো ছবি নয়। দক্ষিণ ভারতীয় ছবির রিমেক। অক্ষয় কুমারও ‘রাউডি রাথোড়’ ছবিতেও পুলিশের ভূমিকায় অভিনয় করে বেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। কিংবা অজয় দেবগনের ‘দৃশ্যম’। পর্দায় চোখ আটকে থাকা গল্প নিয়ে নির্মিত এ ছবিটিও বলিউডের মৌলিক কোনো ছবি নয়।
সবই দক্ষিণ ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে ধার করা। এ রকম আরও অনেক ছবি আছে, যেগুলো বলিউডে রিমেক হওয়ার পর বাংলাদেশি দর্শকরাও ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে পেয়েছেন। গত কয়েক বছর ধরে এ দেশি দর্শকরা দক্ষিণ ভারতের ছবির দিকেই বেশি ঝুঁকছেন। এর কারণ হিন্দি ডাবিং।
সেখানকার মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো একটি নির্দিষ্ট সময় পর ইন্টারনেটে আপলোড হচ্ছে হিন্দি ভাষায় ডাব করে। ফলে এ দেশের দর্শকরা সহজবোধ্য ভাষায় ছবিগুলো দেখছেন এবং মনের কোণে ঠাঁই দিচ্ছেন। দেশি দর্শকদের অনেকেই সেসব ছবিকে এক কথায় তামিল ছবি অবহিত করেন। অথচ অনেকেই জানেন না, দক্ষিণ ভারতে শুধু তামিলই নয়, আরও কয়েকটি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে দক্ষিণ ভারতীয় ছবি এতটা জনপ্রিয় কেন? অনেক সময় নতুন ছবির ক্ষেত্রে (পাইরেটেড) হিন্দিতে ডাবিংও থাকে না। তবুও সেসব ছবি মুহূর্তেই গিলে ফেলছেন এ দেশের একশ্রেণির দর্শক। ভাষা না বোঝা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সেসব তরুণদের মাঝে দক্ষিণ ভারতীয় ছবি নিয়ে এত আগ্রহের কারণ কী? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর মূল কারণ হল ছবির কাহিনী। এ অঞ্চলের ছবিগুলোর গল্প এমন সব ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়, মনে হয় এটি তো বাংলাদেশেরই কোনো অঞ্চলের ঘটনা।
হোক সেটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রোমান্স, থ্রিলার, কমেডি, অ্যাকশান, ড্রামা! এমনকি হরর ছবির ক্ষেত্রেও এসব ইন্ডাস্ট্রির ছবি বলিউডের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। ইদানীংকালে তারা সঙ্গীতেও বেশ উন্নতি করেছে। আরও একটি কারণে এসব ছবি আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়।
সেটা হল- রাজনৈতিক বক্তব্য। ঢাকার কোনো ছবিতে রাজনৈতিক কোনো নেতাকে স্বচরিত্রে দেখানো তো দূরের কথা, তার কোনো নেগেটিভ মন্তব্যও তুলে ধরা যাবে না। অথচ দক্ষিণ ভারতের ছবিতে বিরোধী তো বটে, খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদেরও তুলোধুনা করতে ছাড়েন না। স্বভাবতই নিজের দেশের নির্মাতাদের অপারগতা অন্য কোনো দেশের ছবি দেশেই মনের ঝাল মেটান দর্শকরা।
আগেই বলেছি, দক্ষিণ ভারতীয় ছবি মূলত চারটি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে গড়া। এগুলো হল- তামিল, তেলেগু, মালয়লাম ও কন্নড়। বাংলাদেশে বহুল চর্চিত তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সোনালি যুগ শুরু হয় মূলত এমজিআর এবং শিবাজি গনশেনের হাত ধরে। এরপর হাল ধরেন রজনীকান্ত ও কমল হাসান। চার দশকেরও বেশি সময় তারা রাজত্ব করেছেন।
এখনও করছেন, হয় অভিনয়ে, নয় নির্মাণে। তবে বর্তমানে এ ইন্ডাস্ট্রিতে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে রয়েছেন বিজয়, অজিত কুমার, সুরিয়া, ধানুস, বিক্রম, সেথুপতি। এদের পাশাপাশি বিশাল, জয়াম রবি, অরুণ বিজয়, বিষ্ণু বিশাল, শিবাকার্তিকেয়া, নয়নতারা, সাবিত্রী, জ্যোতিকা, মনোরম, সামান্থা, রেভাথিও রয়েছেন বেশ আলোচনায়। তামিল ছবিগুলোর মধ্যে এমন কিছু বার্তা থাকে, যেটাকে মনে হবে আমাদের দেশেরই অন্যতম কোনো সমস্যা। কী নেই সেসব ছবিতে! পুলিশ বাহিনীর সফলতা ও দুর্নীতির কথা, সেনাবাহিনীর ত্যাগ ও দেশপ্রেম, কৃষকদের দুরবস্থা, ধর্ষণ, চিকিৎসা ব্যবস্থার অসঙ্গতি, সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থার অসঙ্গতি, নারীর ক্ষমতায়ন, নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহার, আরও কত কী!
তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির অবস্থাও তামিলের মতোই। এনটিআর, এএনআর যে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে দিয়েছেন সেটা টেনে নিয়ে গেছেন মেগাস্টার চিরঞ্জীবী। তেলেগু ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছে মহেশবাবু, আল্লু অর্জুন, রামচরণ, জুনিয়র এনটিআর, পবন কল্যাণ, প্রভাষ, বিজয় দেবেরোকোন্ডা টিএন রামা রাম, বৃন্দাবন, সুনীল, কাজল আগারওয়াল, শ্রুতি হাসান, অঞ্জলি দেবী, ভানুশ্রী, আনুশকা শেঠিদের মতো শক্তিশালী তারকা। আরও একটি বিষয়, এ ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতারা দারুণ নাচতে পারেন। এ ইন্ডাস্ট্রিতেও দেশের যাবতীয় সমস্যার গল্প নিয়ে ছবি তৈরি হয়। এখানকার ছবিগুলোর বাজেট অনেক বেশি। অবশ্য তামিল ছবির বাজেটও অনেক।
অন্যদিকে মালয়লাম ছবিগুলোর বাজেট অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু এ ইন্ডাস্ট্রিতে বাস্তবধর্মী ছবিই বেশি তৈরি হয়। বেশ হৃদয়গ্রাহী গল্প নিয়ে এখানকার নির্মাতারা সন্তুষ্ট থাকতে চান। থ্রিলারের ক্ষেত্রে মালয়লামের বিকল্প এখনও বোধহয় ভারতে তৈরি হয়নি। এখানকার কাণ্ডারি হলেন মোহনলাল ও মাম্মুট্টি। তবে পৃথ্বীরাজ, দুলকার, ফাহাদ, নিভিন, টোভিনো, বোবানও ইন্ডাস্ট্রিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় চারটি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সবচেয়ে ছোট হচ্ছে কন্নড় ইন্ডাস্ট্রি। বাজেটের দিক থেকে তারা পেছনে পড়ে থাকলেও যেসব ছবি এ পর্যন্ত ডেলিভারি দিয়েছে, সেগুলোর অনেকটাই বলিউড নির্মাতাদের চিন্তাভাবনার বাইরে। সুদীপ, পুনিথ, ইয়াশ, দর্শন এখানকার জনপ্রিয় তারকা।
একটি বিষয় উল্লেখ্য, তামিল ছবির প্রধান কেন্দ্র হল চেন্নাই শহর এবং তেলেগু ছবির প্রধান কেন্দ্র হায়দ্রাবাদ শহর। অনেক সময় এ দুই ইন্ডাস্ট্রির অনেক তারকাকেই দুই জায়গায়ই কাজ করতে দেখা যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ছবিগুলোকেও একই ইন্ডাস্ট্রির মনে হয়। এর কারণ হল, এ দুই ইন্ডাস্ট্রির শিল্পীদের জনপ্রিয়তা এবং তামিল ও তেলেগু ভাষার মধ্যে কিছুটা মিল থাকা। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশি অনেক ছবির কালার গ্রেডেশন চেন্নাই কিংবা হায়দ্রাবাদ থেকেই করা হচ্ছে। কেউ কেউ আবার এ দুই ইন্ডাস্ট্রি থেকে টেকনিশয়ান এনেও বাংলাদেশে কাজ করছেন।