সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত, দেশে করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যেই হাতছানি দিচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাস। রাজধানীতে গত রোববারে এক দিনেই ১০ জন রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বস্তি থেকে শুরু করে অভিজাত ফ্ল্যাটবাড়িসহ সব জায়গায় সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় মশার উৎপাত। ফলে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা।
২০১৯ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ। গত বছর সরকারি হিসাব মতে, ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ এবং মৃত্যুসংখ্যা ১২১ জন, বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুসংখ্যা ৩ শতাধিক। জনমনে এ আক্রান্ত ও মৃত্যুদাগ কেটে দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে নতুন ভীতিকর অবস্থার। বর্তমানে দেশ করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত। আসন্ন শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউও আসতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যেই করোনার কারণে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি ধামাচাপা পড়তে যাচ্ছে। ফলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ার আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৯৯। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু শিথিল অবস্থায় ছিল। কিন্তু জুন থেকে ফের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে শুরু করে। আইইডিসিআরের তথ্যমতে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৭৩ জন। সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৭ জন এবং ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৪৬ জন।
করোনাভাইরাসে জনগণ শঙ্কিত হওয়ায় ডেঙ্গু ভাইরাস তেমন একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তা ছাড়া করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গুর অন্যতম উপসর্গ মূলত জ্বর। ডেঙ্গু হলেও অনেকে করোনা ভেবে চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না, তা–ও দেখা দরকার। জ্বর হলেই করোনা মনে করে অনেক জায়গায় চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে না গিয়ে ডেঙ্গুর উপর্সগ নিয়েও চলাফেরা করছেন অনেকে। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সঠিক চিত্রও জানতে পারছে না আইইডিসিআর।
ডেঙ্গুর বাহক ছোট্ট একটি মশা। এ মশার নাম এডিস। এ মশারাই তাদের শরীরে বহন করে বেড়ায় ডেঙ্গু রোগের জীবাণু। সাধারণত সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকে; কিন্তু বর্ষাকালে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। কিছুদিন ধরেই সারা দেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এ বৃষ্টির ধরনও ভালো নয়। যার ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকেই যায়। তবে আমরা যদি একটু সচেতন হই, তাহলেই এ থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যাবে।
মশার বংশবিস্তারে বিশেষ করে এডিস মশা যাতে বিস্তার লাভ করতে না পারে, সে জন্য ইতিমধ্যে অবশ্য সিটি করপোরেশন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রতিটি এলাকার স্থানীয় সরকার কর্তৃক সে এলাকার পাবলিক স্পেসগুলো ও মশা বংশবিস্তারের হট স্পটগুলো চিহ্নিত করে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং মশার লার্ভা ও বড় মশকনিধনে নিয়মিত স্প্রে করার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে জনসচেতনতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কীটপতঙ্গ বিশেষজ্ঞ ভি নাগপালের মতে, ১৯টি জায়গায় ডেঙ্গুর বাহক বংশবিস্তার করে থাকে। এগুলো হলো পুরোনো টায়ার, লন্ড্রি ট্যাংক, ঢাকনাবিহীন চৌবাচ্চা, ড্রাম বা ব্যারেল, অন্যান্য জলাধার, পোষা প্রাণীর পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের ব্লক, ফেলে রাখা বোতল, পুরোনো জুতা, ফুলের টব, পরিত্যক্ত খেলনা, ছাদে, অঙ্কুরোদ্গম উদ্ভিদ, বাগান পরিচর্যার জিনিসপত্র, ইটের গর্ত, অপরিচ্ছন্ন সুইমিংপুল প্রভৃতি। এ থেকে বোঝা যায়, এডিস মশার আবাসস্থল সৃষ্টি করছি আমরাই। আমাদের অসচেতনতার কারণেই বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে, ফলে সৃষ্টি হয় এডিস মশার বংশবিস্তার এবং সে মশার কামড়েই আমরা ডেঙ্গু নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছি। তাই মশার বংশবিস্তারে উল্লিখিত স্থানগুলো যদি আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি, তাহলে ডেঙ্গু থেকে অনেকটাই রক্ষা পাব। মনে রাখতে হবে, ভাইরাসের এই সংকট থেকে সরকারের একার পক্ষে কখনোই মুক্ত করা সম্ভব নয়, যদি না আমরা প্রত্যেকে নিজে সতর্ক না থাকি।
আমরা কিন্তু চাইলেই একটু সচেতন হয়ে প্রাণঘাতী এ মশার কামড় থেকে নিজেদের তথা সমাজকে রক্ষা করতে পারি। আসুন মশা বংশবিস্তারে উল্লিখিত স্থানগুলো আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি এবং অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করি মশার আবাসস্থল ধ্বংস করতে। এতে আমি, আপনি এবং আমরা সবাই ডেঙ্গু থেকে নিস্তার পাব এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হারও প্রতিরোধে সক্ষম হব।