স্টাফ রিপোর্টার: দেশের একমাত্র নারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ছাফিয়া খানম। বয়স যখন ১০-১২, নানা প্রতিকূতার মধ্যেও মনের অজান্তে বঙ্গবন্ধুর আর্দশ, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে মুগ্ধ হন। এ সময় তাকে বঙ্গবন্ধু পাগল বলেও ডাকতেন পরিবারে সদস্যরা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকে দুর্বলতা চলে আসে আওয়ামী লীগের ওপরও। এরপর রাজনৈতিক জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পাড় করতে হয় তাকে।
নব্বই দশকে নিজ উদ্যোগে গঠন করেন রংপুর মহিলা আওয়ামী লীগ। নারী নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়নে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করেন। দলকে সুসংগঠিত করেন তৃণমূল পর্যন্ত। লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করা। পরিশ্রমের সফলতা হিসেবে তিনি রংপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। দলের প্রতি ত্যাগ ও নিবেদিত আওয়ামী লীগকর্মী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হন ছাফিয়া খানম। এরপর দলীয় মনোনয়ন পান এবং রেকর্ড গড়ে নির্বাচিত হয়ে যান দেশের প্রথম নারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
ব্যক্তিগত জীবনেও পাহাড় সমান সংগ্রাম করতে হয়েছে ছাফিয়া খানমকে। নাটোর জেলার লালপুর থানার দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের পানসিপাড়া গ্রামে প্রমত্তা পদ্মা নদীর তীরে অজপাড়া গায়ে একটি রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম তার। এক ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি ছোট। চার বছর বয়সেই বাবাকে হারান। অভিভাবকহীন সংসারে বিপাকে পড়েন মা। দুঃসম্পর্কের চাচার সহযোগিতায় লেখপড়া শুরু করেন ছাফিয়া। এরইমধ্যে পদ্মার ভাঙনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গেলে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় তার। দুই বছর বাড়িতে বসে থাকার পর মা ও চাচার চাপে বাল্য বয়সেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। ঘর-সংসার বুঝে ওঠার আগেই কন্যা সন্তানের মা হন। এরপর সন্তানের বয়স নয় মাস হতেই মারা যান ছাফিয়ার স্বামীও।
১৬ বছরেই স্বামী হারা, শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে। আবার তিনি মায়ের কাছে ফিরে আসেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। চোখে অন্ধকার। বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে তার। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকেন। এ সময় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন বান্ধবী খালেদা খানম। বান্ধবী ছাফিয়াকে ষষ্ঠ শ্রেণির বই-পুস্তক দিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেয় এবং লেখাপড়ার খরচ ও উৎসাহ জোগায়। কিন্তু বাধ সাধেন চাচাসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা। তারা সাফ জানিয়ে দেন বিধবা মেয়ের লেখাপড়া হবে না। তিনি জেদ ধরেন লেখাপড়া করবেন। এতে স্বজনদের কাছ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
শুরু হয় তার নতুন জীবনযুদ্ধ। সীমাহীন বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-কষ্ট, আর্থিক অনটনের পরও ১৯৭৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেন ছাফিয়া। চাকরি জোগাড় করে সন্তানের খরচসহ নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। এইচএসসি পাস করার পর ১৮ মাসের কোর্স করে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শকের প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং বিএ ভর্তি হন।
এরইমধ্যে কন্যা বড় হয়ে গেলে তিনি ভাইয়ের স্মরণাপন্ন হয়ে রংপুরে চলে আসেন। রংপুরে আসার পর বিএ, এমএ এবং এলএলবি পাস করেন। পর্যায়ক্রমে অ্যাডভোকেট হয়ে তিনি রংপুর আইন কলেজের প্রিন্সিপাল সিনিয়র আইনজীবী মো. নুরুল হকের জুনিয়র হয়ে কয়েক বছর প্র্যাকটিস করেন। এরপর তার একমাত্র কন্যার লেখাপড়ার কারণে সময় করতে না পেরে তিনি প্র্য্কাটিস ছেড়ে একটি এনজিওতে চাকরি নেন।
চাকরির পাশাপাশি পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। দলের প্রতি ছাফিয়ার ভালোবাসা দেখে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা অ্যাডভোকেট ইলিয়াস আহমেদ, অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন, আশিকুর রহমান এমপি ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তাকে জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক করে নেন।
এ পদ পেয়ে তার মাথায় আসে মহিলা আওয়ামী লীগ গঠনের চিন্তা। নব্বই দশকে নারীদের এক করে গড়ে তোলেন মহিলা আওয়ামী লীগ। ১৯৯৩ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ পদে টানা দুই যুগ পার করে রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে মনোনয়ন চান। রংপুরের একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী ছাফিয়া খানমকে বেছে নেন। তিনি তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন এবং ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি রংপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দায়িত্ব পালনকালে তিনি রংপুর জেলা পরিষদের পীরগঞ্জ খালাশপীরের দখল হওয়া ৬০ শতক জমি ও বদরগঞ্জের জমি উদ্ধারসহ দোকান মার্কেট নির্মাণ করে জেলা পরিষদের আয়ের পথ বের করেন। পাশাপাশি রংপুর নগরের প্রাণকেন্দ্রে জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের পাশে তিন একর জমির ওপর ১৮তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক রংপুর সিটি সেন্টার মার্কেট নির্মাণের কাজ এগিয়ে নেন। এছাড়া মসজিদ, মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কবরস্থান উন্নয়নসহ নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করছেন তিনি।
অ্যাডভোকেট ছাফিয়া খানম বলেন, জীবন চলার পথে যেমন অনেকের কাছ থেকে অবজ্ঞা-অবহেলা পেয়েছি, তেমনি অনেকের সহযোগিতা-ভালোবাসাও পেয়েছি। তবে কোনো দিন অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি এবং আগামীতেও করব না। আমার চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নেই। জীবনের শেষ প্রান্তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন, তা নিয়েই বাঁচতে চাই। (সূত্র: সমকাল, ৮ মার্চ ২০২১)