মো. আলমগীর কবীরঃ চোখের সামনে দৃশ্যমান সকল কিছুই সম্পদ হিসাবে গণ্য। মালিকানা ব্যক্তি বা রাষ্ট্র যারই হোক না কেন সম্পদ রাষ্ট্রের বলে গণ্য হবে। কারণ জিডিপি হিসাব করার সময় রাষ্ট্রের ও ব্যক্তির উভয় সম্পত্তি বিবেচিত হয়। আমাদের দেশের মানুষের নিজ সম্পদ ব্যতিত অন্য যে কারো সম্পদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন এই বিষয়টি ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমিত্ববোধ এখানে বড় একটি নিয়ামক শব্দ। আমার স্বার্থ নিশ্চিত হওয়াটাই এখানে প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
আমিত্বের বিষয়টি আমাদের জীবনের কোন পর্যায় থেকে আরম্ভ হয়? জন্মের পর থেকে মানব শিশুর শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে পিতামাতার চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, আচরণ তথা পরিবারকেই শিশু অনুকরণ করে এবং শিশুর মনোজগৎ গঠিত হয়। এখানে পারিপার্শ্বিকতাও একটি বড় নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
আমরা যদি আমাদের সন্তানদের বুদ্ধি বিকাশের শুরু হতেই ভালো মন্দ, উচিত অনুচিত ইত্যাদি শিক্ষা প্রদানের সাথে সাথে প্রয়োগিক দিকটিও নিশ্চিত করি তাহলে অনিষ্ট শব্দটির অল্পপ্রয়োগ অনেকটাই নিশ্চিত হয়। জাতীয় সম্পদের একটি বড় অংশ মানব সম্পদ। টেকসই নীতির স্বল্পতা এবং প্রায়োগিক অপর্যাপ্ততার কারণে এই সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছেনা ফলে জাতীয় জীবনে ব্যাপক হতাশা বিদ্যমান। প্রতিটি শ্রেণীর পাঠ্য বইয়ে আচরণ, নৈতিক পাঠ এর অধ্যায় থাকলে এর বাস্তব প্রয়োগের বিষয়টি স্বল্প চর্চিত। আচরণের ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় উভয় পাঠের উর্বর ক্ষেত্র হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে ভিন্নতার সংমিশ্রণ থেকে আদর্শের উৎপত্তি হয়।
ফিরে আসি মূল বিষয়ে। আমি সম্প্রতি এক স্কুলে গিয়েছিলাম। একটি শ্রেণিকক্ষের সিলিং ফ্যানের পাখাগুলোর দুর্দশা দেখে সত্যি অবাক হই। হয়তবা বাল্যকালে নিজের খেলনা অকারণে ভাঙার অভ্যাস থেকেই সম্পদ বিনষ্টের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। প্রধান শিক্ষক সাহেব জানালেন যে, ক্লাসরুমের সাউন্ড সিস্টেম, বৈদ্যুতিক বাল্ব, জানালার গ্লাস, বেঞ্চের পায়া কিছুই বাদ যায় না অনিষ্টকারী শিক্ষার্থীদের হাত হতে। পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যুগপৎভাবে প্রয়োগ হলে মনে হয় উক্ত বস্তুগুলির পরমায়ু বৃদ্ধি পেত।
এবার একটি বাস্তব ঘটনার বর্ণনা করি, ঈশ্বরদী থেকে আজিমনগর পর্যন্ত ট্রেনভ্রমণ কালে অতি উৎসাহী এক বন্ধু ট্রেনের জানালার এ্যালুমিনিয়াম তৈরি স্কেল সদৃশ একটি পাতি ভেঙ্গে আমাকে উপহার দেয়, আমি আনন্দচিত্তে উপহারটি নিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। আমার হাতে উক্ত বস্তু দেখে বাবা বস্তুটির প্রাপ্তির উৎসের বিষয়ে জানতে চাইলেন। প্রাপ্তির উৎস জানার পর যথেষ্ট উত্তম মধ্যম দিয়ে যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে আসতে বললেন। তারপর হতে আমি কোনো সরকারি জিনিস বা অন্যকোনো জিনিসে হাত দিতে সাহস করি নাই বা হাত দেই নাই।
ইদানিং কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আচরণ ও ব্যক্তিগত তথা সামষ্টিক পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে টেকসই পাঠ দিয়ে থাকে। বিশেষকরে ক্যাডেট স্কুল ও কলেজগুলিতে পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি কঠোরভাবে পালিত হয়ে কে। ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীগণ যে কোন জায়গায় পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সঠিক নিয়ম পালন করে। রাস্তা ঘাট, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্র তথা সকল জনসমাগম এর জায়গায় যত্রতত্র মানুষ কর্তৃক পরিবেশ বিপর্যয়ের একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। ঐসকল স্থানের অবকাঠামো গুলি ব্যবহারকারী কর্তৃক অতি দ্রুত বিনষ্ট হয়। আমি ব্যবহারের পর আরেকজন ব্যবহার করবেন এই শিক্ষাটি রপ্ত করা জরুরী প্রয়োজন। প্রকৃতি রক্ষা করার শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে।
কিছু দিন পূর্বে রমনা পার্কে প্রাত:ভ্রমণে গিয়েছিলাম। একটি ডালিয়া ফুল ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে ছোট একটা হট্টগোল দেখে এগিয়ে গেলাম। শুনতে পেলাম ঐ ব্যক্তি পাহারাদারকে বার বার সরি বলছে আর বলছে তিনি বুঝতে পারেননি। তার বয়স আনুমানিক ৫০/৫২ বছর তো হবেই, তার বুঝ আসতে আরও সময় লাগবে! পরিবেশ দূষণকারী যেই হোক না কেন তাকে তার কৃতকর্মের জন্য কিছু বললে সরি অথবা বুঝতে পারেননি এই শব্দত্রয়ের অযথা উৎপীড়ন করে থাকেন।
প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন বৃক্ষ, পানি, মাটি, বায়ু আমরা হরহামেশাই নির্বিচারে বিনষ্ট বা দূষিত করছি অথচ ব্যক্তি পর্যায়ের সামান্য সচেতনতাই উল্লেখিত সম্পদগুলির রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। সম্পদ রক্ষার শুদ্ধাচার জাতীয় অভ্যাসের ভাবমূর্তি যেমন বৃদ্ধি করে তেমনি সম্পদের পরিমাণ ও মান বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবারই হবে আমাদের শিক্ষার আতুড় ঘর, পারিবারিক শিক্ষার আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। একে অপরকে অনুকরণ করে রুচিশীল জাতি গঠিত হবে আর এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: মো. আলমগীর কবীর, অতি. ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।